Search This Blog

Saturday, June 14, 2014

চন্ডালের শূদ্র হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনী


চন্ডাল একটি বল-বীর্য সমন্বিত অর্থ দ্যোতক শব্দ। চন্ডের সঙ্গে জাতি সূচক আল প্রত্যয় যুক্ত হলে চন্ডাল হয়। এমনি ভাবে লাঙ্গল,জোঙ্গাল,জঙ্গল,ডাঙ্গাল,বোহাল,খেড়ওয়াল,সাঁওতাল,বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই চণ্ডাল শব্দের গুনগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠবে। ঋকের অনেকগুলি শ্লোকের রচয়িতা বিশ্বামিত্র ছিলেন চণ্ডাল। গুহক চণ্ডাল,রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী অনন্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জাতক কাহিনীতে বোধিসত্ত্বকে সততার প্রতীক হিসেবে চণ্ডাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বহুবার। কার্যসিদ্ধির জন্য সুদাস,মনু,অগ্নী,বরুন প্রভৃতি দাস বা অসুর নেতাদের ও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো বৈদিক সাহিত্যে। অর্থাৎ রক্ষস (পরবর্তী কালে রাক্ষস বলা হয়েছে), অসুর,নাগ,চণ্ডাল শব্দগুলি কোন ভাবেই ঋণাত্মক নয় বরং গুণবাচক এবং ধ্বনাত্মক।

অন্যদিকে নমঃশূদ্র শব্দটি একেবারেই অর্বাচিন বৃটিশ আমলের আরোপিত হীনাত্মক শব্দ। প্রাচীন কোন শাস্ত্রেই এই জাতির কোন উল্লেখ নেই।

১৯১১ সালের সেন্সাসে বাঙলার জাতিগুলির মধ্যে নাম পরিবর্তনের একটা হিড়িক তৈরি করা হয়েছিল। ছোটজাতগুলোকে হিন্দুভুত করার জন্য বাংলার তৎকালীন দিকগজ পণ্ডিতদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মত। "জাতির উন্নয়ন" নামক গাল ভরা নামকরণের আড়ালে তারা বিজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। প্রায় চল্লিশজন নামকরা মহা পণ্ডিত এই বিজ্ঞাপনে সই করে লিখে ছিলেন, "The caste called Namasudra is Brahmin by origin beging descended from the great Beahmin, Kashypa and not "Chandal'। শুধু চন্ডাল নয় এই হিড়িকে সামিল হয়েছিল বাংলা, বিহার ও আসামের তথাকথিত ছোটজাতেরা। আবেদন পত্রের ওজন ছিল দেড় মন। চন্ডালেরা চেয়েছিল নমঃ ব্রাহ্মণ নাম, কোচরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, বৈদ্যরা চেয়েছিল ব্রাহ্মন, কাপালিরা চেয়েছিল বৈশ্যকাপালি , বাগদিরা চেয়েছিল ব্যগ্রক্ষত্রিয়,হাঁড়িরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, সুবর্ণ বিনিকেরা চেয়েছিল বৈশ্য আর পোদরা চেয়েছিল পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়। বিহারের ভূমিহারেরা হল ব্রাহ্মণ। কায়স্থরা প্রথমে শূদ্র পরে ক্ষত্রিয়। দুসাদেরা দাবি করেছিল ক্ষত্রিয়ত্বের।

এর আসল কারন ছিল আইন সভায় সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব করা। বিংশ শতকের শেষ দশকে আগাখাঁ ভাইয়েরা যখন সঠিক ভাবে লোক গণনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিলেন, এবং বার বার প্রমান দাখিল করছিলেন যে, হাড়ি, ডোম, চন্ডাল, সাঁওতালরা কেউই হিন্দু নয়। সংখ্যা অনুপাতে মুসলমানেরাই অনেক বেশী তাই আইন সভায় তাদের বেশী প্রতিনিধি পাওয়া উচিৎ। তখন প্রোমাদ গুনেছিলেন ভূদেবতারা। স্বর্গ বুঝি যায় যায়। সংখ্যা ভারি না হলে বিপদ। যুগযুগ ধরে ঘৃণিত ছোটজাতগুলি মুসলমান শক্তির সাথে পূর্বের মতো হাত মেলালে খাইবার বোলান গিরি পথ দিয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সুতরাং জাতির উন্নয়ন চাই। বিবেকান্দ উদাত্ত কন্ঠে বাহ্মন দের উদ্দেশ্যে আহ্বান করলেন, "এখনো সময় আছে, তুমি কোটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া বল ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী, মুচি, মেথর তোমার রক্ত তোমার ভাই।"
১৮৭৫ সাল পর্যন্ত যাদের ছায়া পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের দূষিত করত দুই দশকের মধ্যে তারা হয়ে গেল, তোমার রক্ত, তোমার ভাই!

আসামের চিফ কমিশনার ১৮৮৫ সালের ৮ই আগস্ট কাছাড় জেলার ডেপুটি কমিশনারকে চিঠি দিয়ে জানালেন যে, চন্ডালদের নমশূদ্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আর কোন আপত্তি নেই। তারপর ওই চল্লিশজন ভূদেবতা জানান যে নমশূদ্ররা চন্ডাল নয়, তারা ব্রাহ্মন দেবতার সন্তান । পূজনীয় এবং নমস্য।
১৮৮৭ তে খুলনার কমিশনার সাহেবের সভায় সচিয়াদহ নিবাসী উমাচরন বিশ্বাস 'শক্তিসঙ্গম তন্ত্র'নামে একখানি শাস্ত্রের প্রাণতোষী নামক অধ্যায়ে "হর-পার্বতী সংবাদে" নম জাতির উল্লেখ আছে বলে লিখিত অংশ পড়ে শোনান এবং দাবী করেন যে তারা নমস মুনির সন্তান। নমস শুদ্র কন্যা বিবাহ করেন। তাই এই জাতি নমঃশূদ্র নামে পরিচিত । পিতৃ সূত্রে তারা বাহ্মন।
যাইহোক 'জাতির উন্নয়ন'নামে তৎকালীন ছোটজাতগুলির মধ্যে হিন্দু করণের হিড়িক পড়ে যায়। ব্রাহ্মনের আইন সভায় যাওয়ার প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু জাতিগুলি সিডিউল্ড তালিকা ভুক্ত হয়ে ব্রাহ্মনের স্থায়ী দাসে পরিণত হয়ে যায়। ১৯১১ সালের সেন্সাসে স্বাধীন বোধি চিত্ত সম্পন্ন একটি প্রাগ বৈদিক জাতি শুদ্রত্বে উন্নীত হয়।
(রেফারেন্স বইগুলির তালিকা দিলে সূতোটি লম্বা হয়ে যাবে। তাই দিলাম না।)

--(লিখেছেন নাগরাজ চন্ডাল )

No comments:

Post a Comment